প্রতিক্ষণ ডেস্ক
ফুটপাথ, সমুদ্র সৈকত কিংবা বস্তিতে খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠা, এরপর এক সময় বিশ্বসেরা তারকা বনে যাওয়া। দক্ষিণ আমেরিকার সব ফুটবল গ্রেটের ক্ষেত্রেই এর যে কোন একটি প্রযোজ্য। নেইমার দ্য সিলভা সান্তোস জুনিয়রের উত্থানও অন্যসব ফুটবল গ্রেটের মতোই। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ আর জীবিকার তাগিদে ফুটবলকে ধ্যান-জ্ঞান ও পেশা হিসেবে বেছে নেয়া।
সাও পাওলোর রাস্তায় ফুটবল খেলতে খেলতে ফুটবলের সঙ্গে প্র্রেম হয়ে যায় সেদিনের ছোট্ট নেইমারের। তবে নেইমারের বিস্ময়কর উত্থানের শুরু ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর তিনি কিশোর প্রতিভা হিসেবে কিংবদন্তি পেলের সাবেক ক্লাব সান্তোসে যোগ দেন। নেইমারের বাবা ‘সিনিয়র নেইমার দ্যা সিলভা’র ইচ্ছে ছিল বড় মাপের ফুটবলার হয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর। সেই লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের মধ্যাঞ্চলের শহর সাও ভিনসেন্ট ছেড়ে সাও পাওলোর মগি দাস ক্রুজেস শহরে পাড়ি জমান। কিন্তু পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় সিনিয়র নেইমারের।
নিদারুণ ওই দুঃসময়ে সিনিয়র নেইমারের ভালবাসার প্রতীক হিসেবে ঘর আলো করে আসে ব্রাজিলের বস্তি থেকে ফুটবল বিশ্ব শাসন করতে আরও একজন বিস্ময়বালক। এরপর স্বপ্নের পরিধি বেড়ে যায় তার। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ছেলেকে দিয়ে পূরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এ কারণে অভাবের সংসার হলেও ছেলেকে এর আঁচ লাগতে দেননি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন উত্তরসূরির চাওয়া পূরণ করতে। ছোট্ট ছেলের প্রতিভা ক্ষুরধার হওয়ায় কাজটাও সহজ হয়।
কথিত আছে ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের ফুটবল ক্লাবগুলো তাদের দেশের উঠতি খেলোয়াড়দের পরিপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলে ইউরোপের ক্লাবগুলোর কাছে বেশি দামে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে। নতুন খেলোয়াড় গড়ে বিদেশি ক্লাবের কাছে বিক্রি করাই তাদের আয়ের মূল উৎস। কিন্তু নেইমারের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। সে সময় নেইমার সবে মাত্র “সান্তোসের” জুনিয়র দলের সিড়ি বেয়ে পেশাদার লীগে পা রেখেছে। এমন সময় এক বিকেলে ইংল্যান্ডের ক্লাব ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড এর এক স্কাউটের নজড় পড়ে নেইমারের দিকে। ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড নেইমারকে কেনার জন্য ১২ মিলিয়ন পাউন্ডের অফার দেয়। এতো বড় অংকের অফার পাওয়া সত্ত্বেও সেসময় “সান্তোস” নেইমারকে বিক্রি করেনি। কেননা তারা নেইমারের মধ্যে এমন কিছু দেখেছিলেন যা এই প্রস্তাবের কাছে তুচ্ছ। বিশ্বফুটবলের মানচিত্রে এভাবেই পরিচিত হয়ে উঠলেন নেইমার দা সিলভা সান্তোস জুনিয়র, সংক্ষেপে নেইমার।
নেইমার তখনো ব্রাজিলের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পায় নি। এরই মধ্যে ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড বড় অংকের টাকা অফার করেও নেইমারকে দলে নিতে পারে নি। তাই বলে ইউরোপের অন্য ক্লাবগুলো বসে থাকে নি। এরপর ইউরোপের আরেক জায়ান্ট চেলসি নেইমারকে দলে নিতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সান্তোস কর্তৃপক্ষকে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়েছে নেইমারকে ইউরোপের ক্লাবগুলোর স্কাউটদের লোভনীয় ফাঁদ থেকে আগলে রাখতে।
সান্তোসের হয়ে প্রথম মৌসুমে খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারেননি নেইমার। কেননা প্রথম দিকে নেইমারকে খেলানো হতো না। ২০০৯ সালের ১১ই এপ্রিল ব্রাজিলিয়ান কাপের শেষের দিকে সুযোগ পেয়ে সেমিফাইনালে পালমেইরাসের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেও সান্তোসকে ফাইনালে তুলতে পারেননি। পরের মৌসুমে সুযোগ পেয়েই ঝলসে উঠলেন। ২০১০ সালের ব্রাজিলিয়ান কাপের শিরোপার সাথে সাথে অর্জন করেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও। এই লীগে নেইমার ১৯ খেলায় ১৪ গোল করেন। সে সময়ই চারিদিকে নেইমার নেইমার রব পড়ে যায়। নেইমারের নৈপুণ্যে সান্তোস ব্রাজিলিয়ান লিগ কাপ আর কোপা লিবার্তাদোরেসের ট্রেবল শিরোপা অর্জন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাজিলিয়ানরা নেইমারকে পেলের উত্তরসূরি হিসেবে ভাবতে শুরু করে এবং ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ হয় নেইমারের।
ব্রাজিল জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার আগে থেকেই নেইমারের নাম ডাক থাকলেও কনফেডারেশন্স কাপ নেইমারের তারকখ্যাতি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। ২১ বছর বয়সী এই প্রাণচঞ্চল তরুণ ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নবম ফিফা কনফেডারেশন্স কাপে আরেকবার চিনিয়েছেন নিজের জাত। বিশ্বের বাঘা ফুটবলারদের পেছনে ফেলে আসরের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন। এ আসরে নেইমার ৪ গোল করেন। নিজ দেশ ব্রাজিলকে ঐতিহাসিক হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ে কারিগরের ভূমিকা পালন করেন।
প্রতিক্ষণ/এডি/আরএম